নরসিংদীর চরাঞ্চল আলোকবালীতে চলমান সহিংসতা ও রাজনৈতিক দমনপীড়ন ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দাপটে বিএনপির প্রায় ৩শ নেতাকর্মী গ্রামছাড়া হয়ে পড়েছেন। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও আওয়ামী চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের মুখে বিএনপির এসব নেতাকর্মী গ্রামছাড়া হয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, আলোকবালী ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়কসহ ৩ জনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তাদের সন্ত্রাস বাহিনীর সদস্যরা প্রকাশ্যে এলাকায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে; যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এছাড়া সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করতে প্রতিদিন ককটেল বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে।
ফলে ভয়ে ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ওই এলাকার মানুষজন। সন্ত্রাসীদের দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সেখানকার জনজীবন। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে প্রকাশ্যে মহড়া দিলেও অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা চোখে পড়েনি। ফলে হতাশ হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দিলেও নরসিংদীর আলোকবালীতে আওয়ামী লীগ সভাপতি আসাদ বাহিনী ও আওয়ামী চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপু বাহিনীর তাণ্ডব এখনো কমেনি। গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগ সভাপতি আসাদ বাহিনী ও আওয়ামী চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপু বাহিনীর হাতে বিএনপির দুইজনসহ ৩ জনকে প্রকাশ্যে খুন করলেও মূলহোতাদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
জানা যায়, নরসিংদী সদর উপজেলা মেঘনা নদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল আলোকবালী। এই ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ আসাদ এবং সাবেক সভাপতি ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপু।
দীপু সদর আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) মো. নজরুল ইসলাম হিরুর সমর্থক। ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ আসাদ নরসিংদী শহরের সন্ত্রাসীদের গড ফাদার ও সাবেক পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুলোর সমর্থক। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আসাদ ও দীপু মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে শত কোটি টাকা কামিয়েছেন।
জুলাই ২৪-এ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যায়। ওই সময় আসাদ ও দীপু বাহিনীও গাঁ ঢাকা দেয়। গত মাসের ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর রাতে আসাদ ও দীপু বাহিনী কয়েকশ সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আলোকবালী ইউনিয়নের মুরাদনগর গ্রামে অবস্থান নেয়। ওই সময় তারা গ্রামবাসী ও বিএনপির নেতাকর্মীর উপর এলাপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে।
ওই সময় ইদন মিয়া নামে এক বিএনপি কর্মীকে প্রকাশ্য গুলি করে হত্যা করে তারা এলাকায় অবস্থান নেয়। পর দিন ফেরদৌসি নামে এক নারীকে গুলি করে হত্যা করে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ১০ দিনের মাথায় ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেক মিয়াকে স্থানীয় বাজারে প্রকাশে গুলি করে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসী আসাদ ও দীপু সমর্থকরা।
এর পরপরই আলোকবালী, মুরাদনগর, বাখননগর ও বইস কালিপুর গ্রামে নিষিদ্ধ কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতি আসাদ ও আওয়ামী চেয়ারম্যান দীপুর সন্ত্রাসীরা একছত্র অবস্থান নেয়। পরে তারা এলাকার বিএনপি নেতাকর্মীদের টার্গেট করে রাতের বেলায় বাড়ি বাড়ি হামলা করে। এতে ভয়ে ও আতঙ্কে ওই গ্রামের প্রায় ৩ শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী গ্রাম ছাড়া হয়ে পড়েন। বিএনপি নেতাকর্মীরা গ্রামে প্রবেশ করতে চাইলেই তাদের হামলার শিকার হতে হচ্ছে।
নিহত বিএনপি কর্মী ইদন মিয়ার ছেলে আল মামুন বলেন, ৫ আগস্টের পর আসাদ ও দীপু বাহিনী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে শক্তি সঞ্চয় করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র গোলাবারুদ ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের নিয়ে পুনরায় ১৮ সেটেম্বর গ্রামে ফিরে আসে। এসেই আমার বাবাকে হত্যা করে। বিএনপি নেতাকর্মীদের দেখলেই গুলি করে হত্যা করে। প্রাণভয়ে আমরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। তাদের আইনের আওতায় না আনলে গ্রামে শান্তি ফিরবে না।
নিহত যুবদল নেতা সাদেক মিয়ার ভাই আবুল হোসেন বলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আমার ভাইকে প্রকাশ্যে গুলি করে মারল। আবার তারাই আমাদের এলাকাছাড়া করে রেখেছে। কেউ গ্রামে ঢুকলেই তাদের গুলি করে হত্যা করছে। সেই ভয়ে কেউ এলাকায় যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তাই প্রশাসনের কাছে জোর দাবি- এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সদর থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হাসান বলেন, ফ্যাসিস্টরা ১৭ বছর আমাদের নির্যাতন করেছে। ভেবেছিলাম এখন শান্তিতে থাকতে পারব। কিন্তু না, তারা প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে এলাকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে রেখেছে। তাই বিএনপি নেতাকর্মীরা গ্রামে যেতে ভয় পায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর গ্রামবাসী জানান, মূলত মেঘনা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের জন্যই আসাদ ও দীপু বাহিনীরা এসব করে বেড়াচ্ছে। তারা ১৭ বছর নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছে। কিছুদিন শান্তি ছিল। এখন পুনরায় বালু উত্তোলন করতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামগুলো দখলে নিয়েছে। আমরা তাদের প্রতিকার চাই।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে আলোকবালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ আসাদ ও ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
নরসিংদী পুলিশ সুপার মেনহাজুল আলম বলেন, আলোকবালীতে দাঙ্গা ও হানাহানির সঙ্গে যেই জড়িত থাকুক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। সহিংসতা বন্ধে ইতোমধ্যেই সেখানে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তাছাড়া এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় জেলা প্রশাসক, সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ রাজনিতিক ও গ্রামবাসীদের নিয়ে সচেতনতামূলক মতবিনিময় ও ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে। আশা রাখছি আলোকবালীতে সহিংসতা কমে আসবে।
বিএনপির ৩শ নেতাকর্মী গ্রামছাড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নানা বিষয়েই বিভিন্ন রকম তথ্য আমাদের কানে আসছে। আমার সেগুলো যাচাই বাছাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
